তারাপীঠ: মার্কেণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধের জন্য ‘দেবী দুর্গা’ যখন ক্রোধান্বিত হন তখন তাঁর ভ্রূকুটি যুগল থেকে ‘কৌশিকী দেবী’ আবির্ভূতা হন এবং অসুর ভাতৃদ্বয় শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন। সেই থেকেই এই কৌশিকী দেবী ‘কালী’ তথা ‘মহাকালী’ রূপে পূজিতা হন। হিন্দু ধর্ম মতে এই অমাবস্যা তিথি নক্ষত্রেই কৌশিকী দেবী আবির্ভূতা হন। আর সেই কারণেই এই অমাবস্যা তিথি নক্ষত্রের নামকরণ হয় কৌশিকী অমাবস্যা।
এবার জেনে নেওয়া যাক এই অমাবস্যার তাৎপর্য-
চণ্ডী অনুযায়ী এই কৌশিকী অমাবস্যা বছরের আর বাকি অমাবস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি…।
এই অমাবস্যায় গোটা ব্রহ্মাণ্ডে দশ মহাবিদ্যার দ্বিতীয় মহাবিদ্যা ‘তারা দেবী’কে ‘মহাকালী’ রূপে আহ্বান করা হয়। কথিত আছে, এই দিনেই নাকি সাধক শ্রেষ্ঠ বামাক্ষ্যাপা তাঁর ‘বড় মা’ অর্থাৎ ‘তারা দেবী’র দর্শন পেয়ে সিদ্ধিলাভ করেন। বলা হয়, এই দিনে কোনও ভক্ত ‘তারা দেবী’কে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলে তার মনঃস্কামনা পূর্ণ হয়। উল্লেখ্য, প্রতিবছরই আজকের দিনে বীরভূমের তারাপীঠ মন্দিরেও ‘মহাকালী’র আহ্বান করা হয়।
মৎস পূরাণ ও মাণ্ডেয় পূরাণে বলা হয়, অসুর দ্বয় শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করতে দেবী পার্বতী সাধনা শুরু করেন। তপস্যার পর, নিজের শ্বেতশুভ্র গায়ের রঙ পরিত্যাগ করে ,উজ্জ্বল কালো বর্ণে ভয়াল রূপ ধারণ করেন দেবী। সেই রূপে দেবী পার্বতী হয়ে ওঠেন ‘কৌশিকী’। আর এই কৌশিকীই অমাবস্যার এক বিশেষ কালক্ষণে, অন্ধকারে বধ করেন শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই অসুরকে। সেই কারক্ষণকে স্মরণ করেই অনুষ্ঠিত হয় কৌশিকী অমাবস্যার পূজা।
শুধু হিন্দু মতে নয়, বৌদ্ধ মতেও তন্ত্র সাধনার জন্য এই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শাস্ত্রজ্ঞরা বলেন, কৌশিকী অমাবস্যার রাতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তিকে সাধনার মাধ্যমে তান্ত্রিকরা ধারণ করে থাকেন। যে সাধনার ফলে বলা হয়, আশাতীত ফল লাভ করেন তন্ত্রসাধকরা। তারাপীঠের মহাশ্মশানে এই তন্ত্রসাধনা হয়ে থাকে এই পূণ্য তিথিতে।
কথিত আছে, এই তিথিতেই দশ মহাবিদ্যার অন্যতম দেবী তারা মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হন, আবার এই তিথিতেই সাধক বামাক্ষ্যাপা তারাপীঠে পঞ্চমুন্ডির আসনে সিদ্ধিলাভ করেন।
তারাপীঠে এই উপলক্ষ্যে মায়ের পূজা দিতে হাজার হাজার শরণার্থী ভিড় করেন।
তারাপীঠে তারা মন্ত্রে প্রথম সিদ্ধিলাভ করেন মহামুনি বশিষ্ঠ। তারাপীঠ বশিষ্ঠদেবের সাধনপীঠ হিসেব প্রসিদ্ধ।
একবার ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠদেব ব্রহ্মলোকে গিয়ে পিতাকে বললেন, “আমি এমন বিদ্যার সাধনা করতে চাই যার সিদ্ধিলাভে সকল বিদ্যা করায়ত্ত হবে। সর্বজ্ঞান লাভ করে আমি ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারব।” ব্রহ্মা বললেন, “দশমহাবিদ্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহাবিদ্যা হলেন মা তারা। তিনিই পূর্ণব্রহ্ম। তিনি সাকার এবং নিরাকারা দুই-ই। নিরাকারে তাঁর স্বরূপ দুর্জ্ঞেয় আর সকার অবস্থায় তাঁর রূপটি হলো শবরূপী মহাদেবের হৃদয়ে দন্ডায়মানা’। প্রস্ফুটিত নীলপদ্মের মত তাঁর ত্রিনয়ন। তাঁর চার হাতে কর্তিকা, নরকপাল, পদ্ম আর খড়্গ। তিনিই রক্ষাকর্ত্রী। সমুদ্রমন্থনকালে মহাদেব বিষ পান করে নীলকন্ঠ হলে মহাদেবের বিষ হরণ করে তাঁকে মা তারা ত্রাণ করেন। তাই তিনি ত্রিলোকে তারিণী নাম খ্যাত।” এই বলে তিনি বশিষ্ঠদেব কে তারামন্ত্র দান করে ঐ বিদ্যার সাধনা করতে বললেন।
বশিষ্ঠদেব কামগিরি পর্বতে (কামাখ্যা) গিয়ে বহু বছর ধরে তপস্যা করেও সিদ্ধিলাভে ব্যর্থ হন। মন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে বশিষ্ঠদেব পিতা ব্রহ্মার কাছে অনুযোগ করে বললেন, মন্ত্র কাজ করছে না, অন্য মন্ত্র দিন। ব্রহ্মা তাঁকে বোঝালেন, “তুমি মনপ্রাণ দিয়ে যোগস্থ হয়ে মায়ের শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাও, কল্পতরু অম্বা তোমার প্রার্থনা আবশ্যই পূরণ করবেন।” আদেশ শুনে বশিষ্ঠদেব আবার জপে মনোনিবেশ করলেন, কেটে গেল আরো বহু বছর। তাও দেবী দেখা দিলেন না। ক্রুদ্ধ বশিষ্ঠ ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। মন্ত্র যখন নিষ্ফল, তখন এই মন্ত্রকে ধরণীতল থেকে একেবারে বিলুপ্তই করে দেব। হাতে জল নিয়ে মহাবিদ্যাকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হতেই আকাশমার্গে তারাদেবীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল- “বৃথা তপঃশক্তি ক্ষয় কেন করছ? যে আমার সাধনা জানে না, আমার ভাবের সাথে যার পরিচয় নেই, সে কি করে যোগের সাহায্যে আমার দর্শনলাভ করবে ! বেদেও আমার সাধনার কোন ইঙ্গিত দেওয়া নেই। সুতরাং তুমি মহাচীনে যাও। সেখানে অথর্ববেদ অনুসরণকারী সাধকদের পাবে। ওঁদের মধ্যে বুদ্ধরূপী জনার্দনকে পাবে। তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনিই তোমাকে সাধনপদ্ধতি শিখিয়ে দেবেন।”
দেবীর কথামত বশিষ্ঠদেব মহাচীনে গেলেন। গিয়ে দেখলেন বুদ্ধরূপী জনার্দন সেখানে পঞ্চ’ম’ কারে (মদ,মাংস,মৎস্য,মুদ্রা,মৈথুন) তারা মায়ের সাধনা করছেন। তিনি অত্যন্ত শুদ্ধ বেদাচারী। তিনি ঘৃণা বোধ করে যখন ফিরে আসছেন তখন দৈববাণী হলো, “পুত্র বশিষ্ঠ, হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। আমার উপাসনার আচার হলো এই পঞ্চ’ম’-কার। এই আচারকে ‘চীনাচার’ বা ‘কৌলাচার’ বলে। এই শিক্ষা গ্রহণ না করলে তুমি সিদ্ধ হবে না।” এই শুনে বশিষ্ঠদেব জনার্দনের কাছে পঞ্চ’ম’-কার সাধন পদ্ধতি সমন্ধে শিক্ষালাভ করলেন।
গুরুর আদেশ অনুযায়ী কামকোটির বক্রেশ্বরের ঈশান কোনে, বৈদ্যনাথ ধামের পূর্বদিকে, দ্বারকা নদীর পূর্বতীরে চন্ডীপুর বা তারাপুর মহাশ্মশানে এক শ্বেত শিমূল বৃক্ষের মূলে তারা মায়ের শিলামূর্তির খোঁজ পান। ওই বৃক্ষতলে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে চীনাচারে শিলাময়ী দ্বিভুজা তারা দেবীর সাধনায় মগ্ন হলেন। তাঁর ধ্যানমূর্তিটি হলো- দ্বিভুজা, সর্পময়যজ্ঞপোবীত ভূষিতা। তাঁর বাম কোলে স্বয়ং মহাদেব পুত্ররূপে অবস্থান করে স্তন পান করছেন।
দীর্ঘ সাধনার পর বশিষ্ঠদেব বহু আকাঙ্খিত তারামায়ের দর্শনলাভ করেন। শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা তারা রূপেই বশিষ্ঠদেবকে দর্শন দেন এবং এই রূপটি প্রস্তরীভূত হয়। সেই থেকে তারাপীঠ মন্দিরে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা মূর্ত্তিতে দেবী তারা পূজিত হয়ে আসছেন। মায়ের শিলারূপ ঢাকা থাকে একটি আচ্ছাদনে। সেই আচ্ছাদনকেই মাতৃরূপের প্রতীক ধরা হয়। এই মূর্তিই তারামূর্তি হিসেবে ঘরে ঘরে পূজিতা।
তারাপীঠ মহাশ্মশানস্থিত পঞ্চমুণ্ডের আসন। এখানে পাঁচটি মুণ্ড সাপের, ব্যাঙের, খরগোশের, শিয়ালের এবং মানুষের। এই আসনে বসেই বহু যুগ পূর্বে দেবীকে তুষ্ট করে তারাপীঠকে সিদ্ধপীঠে পরিণত করেছিলেন বশিষ্ঠদেব। পরবর্তীতে ভৃগু, দত্তাত্রেয়, পরশুরাম, এই আসনে বসে তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। পরবর্তীতে আনুমানিক ১২৭৪ বঙ্গাব্দের কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে তারাপীঠ মহাশ্মশানের শ্বেতশিমূল বৃক্ষের নীচে সাধক বামাক্ষ্যাপা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। সেই আসন আজও বিদ্যমান। অর্থাৎ, এই আসন আজও জাগ্রত। খুব শুদ্ধচিত্তের মানুষ না হলে এই আসনে বসা মাত্র সারা শরীরে তীব্র জ্বালা শুরু হয়। সেই জ্বালায় উন্মাদ হয়ে যায় মানুষ।
প্রিয় বন্ধুরা আজকের অনুষ্ঠান এপর্যন্তই। খুব তারা তারি ফিরে আসবো নতুন কোনো অজানা তথ্যের ভিডিও নিয়ে। সকলে ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন , আর দেখতে থাকুন আমাদের চ্যানেল সমাধান।
জয় মা তারা