কৈলাস শিখরে শিব-পার্বতী বাস করতেন। গন্ধর্ব, সিন্ধ, চারণ প্রভৃতি তাঁদের সেবা করতো। পরম সুখে ছিলেন শিব-পার্বতী। একদা পার্বতী শিবকে প্রশ্ন করলেন, “ভগবান, আপনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ-দাতা। আপনি কোন ব্রত বা তপস্যায় সন্তুষ্ট হন ?”

দেবী পার্বতীর কথা শুনে শিব বললেন, “দেবী, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথির রাত্রিকে শিবরাত্রি বলা হয়। এ রাত্রিতে উপবাস করলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হই। স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় আমি যতটুকু সন্তুষ্ট হই তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হই শিবরাত্রির উপবাসে।”

প্রিয় পত্নী পার্বতীকে শিব বললেন, “এদিন যারা সারা দিন উপবাস করে রাত জেগে আমার পুজো করবে‚ মাথায় বেলপাতা ও গঙ্গাজল ঢালবে‚ তারা যত পাপই করুন না কেন‚— আমি তাদের পাপের বোঝা মুক্ত করে সত্যস্বরূপে প্রতিষ্ঠা করব।”

শিব পার্বতীকে আরও বললেন, “ব্রতপালনকারী ত্রয়োদশীতে স্নান করে সংযম পালন করবে। স্বপক্ব নিরামিষ বা হবিষ্যান্ন ভোজন করবে। স্থণ্ডিল ( -মানে ভূমি বা বালু বিছানো যজ্ঞবেদী) অথবা কুশ বিছিয়ে শয়ন করে আমার- (অর্থাৎ শিবের) নাম স্মরণ করতে থাকবে। রাত্রি শেষ হলে, শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃ ক্রিয়াদি করবে, অন্যান্য আবশ্যক কার্যাদি করবে। সন্ধ্যায় যথাবিধি পূজাদি করে বিল্বপত্র সংগ্রহ করবে। তারপর নিত্যক্রিয়াদি করবে। অতঃপর স্থণ্ডিলে (-মানে যজ্ঞবেদীতে), সরোবরে, প্রতীকে বা প্রতিমায় বিল্বপত্র দিয়ে আমার পূজা করবে। একটি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করলে আমার যে প্রীতি জন্মে, সকল প্রকার পুষ্প একত্র করে কিংবা মণি, মুক্তা, প্রবাল বা স্বর্ণনির্মিত পুষ্প দিয়ে আমার পূজা করলেও, আমার তার সমান প্রীতি জন্মে না। প্রহরে প্রহরে বিশেষ ভাবে স্নান করিয়ে আমার পূজা করবে। পুষ্প, গন্ধ, ধূপাদি দ্বার যথোচিত অর্চনা করবে। প্রথম প্রহরে দুগ্ধ, দ্বিতীয় প্রহরে দধি, তৃতীয় প্রহরে ঘৃত এবং চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে আমাকে স্নান করাবে এবং পূজা করবে। এছাড়া যথাশক্তি নৃত্যগীতাদি দ্বারা আমার প্রীতি সম্পাদন করবে। হে দেবী, এই হল আমার প্রীতিকর ব্রত। এ ব্রত করলে তপস্যা ও যজ্ঞের পুণ্য লাভ হয় এবং ষোল কলায় দক্ষতা জন্মে। এ ব্রতের প্রভাবে সিদ্ধি লাভ হয়। অভিলাষী ব্যক্তি সপ্তদীপা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়।”

এর পর শিব তার প্রিয় পত্নী পার্বতীকে বললেন, এবার শিবচতুদর্শী তিথির মাহাত্ম্য বলছি, শোনো। একদা সর্বগুণযুক্ত বারাণসী পুরীতে ভয়ঙ্কর এক ব্যাধ বাস করত। বেঁটে-খাটো ছিলো তার চেহারা, আর তার গায়ের রং ছিলো কালো। চোখ আর চুলের রং ছিলো কটা। নিষ্ঠুর ছিলো তার আচরণ। ফাঁদ জাল, দড়ির ফাঁস এবং প্রাণী হত্যার নানা রকম হাতিয়ারে পরিপূর্ণ ছিলো তার বাড়ি। একদিন সে বনে গিয়ে অনেক পশু হত্যা করলো। তারপর নিহত পশুদের মাংসভার নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। পথে ক্লান্ত হয়ে সে বনের মধ্যে বিশ্রামের জন্য একটি বৃক্ষমূলে শয়ন করলো এবং একটু পরেই নিদ্রিত হলো। সূর্য অস্ত গেলো, এল ভয়ঙ্কর রাত্রি। ব্যাধ জেগে উঠলো। ঘোর অন্ধকারে কোন কিছুই কারও দৃষ্টিগোচর হলো না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে একটি শ্রীফলবৃক্ষ অর্থাৎ বিল্ববৃক্ষ পেল। সেই বিল্ববৃক্ষে সে লতা দিয়ে তার মাংসভার বেঁধে রাখলো। বৃক্ষতলে হিংস্র জন্তুর ভয় আছে। এই ভেবে সে নিজেও ঐ বিল্ববৃক্ষে উঠে পড়লো। শীতে ও ক্ষুধায় তার শরীর কাপঁতে লাগলো। এভাবে সে শিশিরে ভিজেই জেগে কাটালো সারা রাত। দৈববশতঃ সেই বিল্ববৃক্ষমূলে ছিলো আমার (অর্থাৎ শিবের) একটি প্রতীক। তিথিটি ছিল শিবচতুর্দশী। আর ব্যাধও সেই রাত্রি কাটিয়েছিলো উপবাসে। তার শরীর থেকে আমার প্রতীকের ওপর হিম বা শিশির ঝরে পরেছিলো। তার শরীরের ঝাঁকুনিতে বিল্বপত্র পরেছিলো আমার প্রতীকের ওপর। এভাবে উপবাসে বিল্বপত্র প্রদানে এবং শিশির স্নানে নিজের অজান্তেই ব্যাধ শিবরাত্রি ব্রত করে ফেললো।

হে দেবী, তিথি মাহাত্ম্যে কেবল বিল্বপত্রে আমার যে প্রীতি হয়েছিলো, স্নান, পূজা বা নৈবেদ্যাদি দিয়েও সে প্রীতি সম্পাদন করা সম্ভব নয়। তিথি মাহাত্ম্যে ব্যাধ মহাপূণ্য লাভ করেছিলো। পরদিন উজ্জ্বল প্রভাতে ব্যাধ নিজের বাড়িতে চলে গেলো। কালক্রমে ব্যাধের আয়ু শেষ হলো। যমদূত তার আত্মাকে নিতে এসে তাকে যথারীতি যমপাশে বেঁধে ফেলতে উদ্যত হলো। অন্যদিকে আমার প্রেরিত দূত ব্যাধকে শিবলোকে নিয়ে এলো। আর আমার দূতের দ্বারা আহত হয়ে যমদূত যমরাজকে নিয়ে আমার পুরদ্বারে উপস্থিত হলো। দ্বারে শিবের অনুচর নন্দীকে দেখে যম তাকে সব ঘটনা বললেন। এই ব্যাধ সারা জীবন ধরে কুকর্ম করেছে, জানালেন যম। তাঁর কথা শুনে নন্দী বললেন, ধর্মরাজ, এতে কোন সন্দেহই নেই যে ঐ ব্যাধ দুরাত্মা। সে সারা জীবন অবশ্যই পাপ করেছে। কিন্তু শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্ম্যে সে পাপমুক্ত হয়েছে এবং দেবাদিদেব, সর্বেশ্বর শিবের কৃপা লাভ করে শিবলোকে এসেছে।

নন্দীর কথা শুনে বিস্মিত হলেন ধর্মরাজ। তিনি শিবের মাহাত্ম্যর কথা ভাবতে ভাবতে যমপুরীতে চলে গেলেন।
-“এই হলো শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম্য।”

শিবের কথা শুনে শিবজায়া হিমালয় কন্যা পার্বতী বিস্মিত হলেন। তিথি শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম্য নিকটজনের কাছে বর্ণনা করলেন। তাঁরা আবার তা ভক্তি ভরে জানালেন পৃথিবীর বিভিন্ন রাজাকে। এভাবে শিবরাত্রিব্রত পৃথিবীতে প্রচলিত হলো।

ত্রয়োদশী তিথিতে সংযত হয়ে থেকে চতুর্দশী তিথিতে উপবাস, রাত্রি জাগরণ ও মহাদেবকে (-শিবলিঙ্গকে) নিয়ে প্রদোষকালে দুধ দিয়ে, দ্বিতীয় প্রহরে দই দিয়ে, তৃতীয় প্রহরে ঘি দিয়ে আর চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে স্নান করানো ও পূজা করা বিধেয়।

অতপর পুজা সমাপ্ত করে ব্রতকথা শ্রবণ করতে হবে।

পরের দিন পারন করতে হয়। শিবরাত্রির পারণ মন্ত্রের অর্থ হলো এইরূপ – হে শিব ! তুমি নরকরূপ মহাসমুদ্রের মত জীবন পারাপারের নৌকাস্বরূপ। তোমাকে নমস্কার। তুমি সৌভাগ্য, আরোগ্য, বিদ্যা, অর্থ, স্বর্গ, অপবর্গ দিয়ে থাকো। আমি তোমার কাছে এগুলি প্রার্থনা করছি। হে গৌরীপতি ! তুমি আমাকে ধর্ম দাও, জ্ঞান দাও, সৌভাগ্য দাও, সুখস্বর্গ দাও। পারনের সময় পঞ্জিকা তে দেয়া থাকে, এর মাঝে মহাদেব কে অন্ন নিবেদন করে পারণ করে উপোস ভঙ্গ করতে হয়।

প্রিয় বন্ধুরা আজকের অনুষ্ঠান এপর্যন্তই। খুব তারা তারি ফিরে আসবো নতুন কোনো অজানা তথ্যের ভিডিও নিয়ে। সকলে ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন , আর দেখতে থাকুন আমাদের চ্যানেল সমাধান।

ॐ নমোঃ শিবায়
হর হর মহাদেব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *