নমস্কার বন্ধুরা, সমাধান অনুষ্ঠানে আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই। আশাকরি আপনারা সবাই খুব ভালো আছেন। বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব দুর্গোৎসবের সন্ধিক্ষণে মা আনন্দময়ীর আনন্দের ছোয়ায় আমাদের সবার মধ্যেই একটা খুশির অনুভূতি বিরাজ করছে। করোনার এই সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্যেও মা দুর্গার আবাহনের মধ্যে দিয়ে এক নতুন উজ্জল প্রভাতের ইঙ্গিত যেন আমাদের সবার মনেই এক আনন্দ মুখরিত আসার আলো সঞ্চার করেছে। অশ্বিনের স্নিগ্ধ আকাশ ও দিকে দিকে কাশ ফুল বনের ঢেউ যেন আমাদের প্রতিনিয়ত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মহালয়ার সেই সন্ধিক্ষণে – যেদিন দেবীপক্ষের সূচনার সাথে সাথে অবসান হয় পিতৃপক্ষের। এই মহালয়ার প্রাক্কালে আসুন আমরা সবাই একটু দেবী দুর্গার কিছু রহস্যময় অজানা তথ্যের সম্বন্ধে জানতে ব্রতী হয়। তার সাথেই আমরা জানবো মা দুর্গার ধ্যান ও মন্ত্রের সম্বন্ধে। পৃথিবীতে কিভাবে প্রচলন হলো মা দুর্গার পূজা, মায়ের দশ হাতের অস্ত্র কিভাবে পেলেন , কেন মায়ের নাম হলো দূর্গা – ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য নিয়েই থাকছে আমাদের আজকের অনুষ্ঠান- মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার আদি সন্ধানে।
আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ আপনারা ভিডিওটি পুরোটা দেখুন , যদি ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই লাইক করুন, শেয়ার করুন। আমাদের চ্যানেলে নতুন হলে অবশ্যই সাবস্ক্রাইব করুন ও নতুন সব ভিডিওর তারা তারি নোটিফিকেশন পেতে বেল আইকন টিকে প্রেস করে রাখুন।
মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার পূজার আদি সন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, জগতে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আছে, পরমাত্মা কৃষ্ণ সৃষ্টির প্রথম কালে মহারাসমণ্ডলে এই আরাধনা করেন। তার পর ব্রহ্মা। মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুরের হাত থেকে ত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে। তৃতীয় পূজা করেন শিব, ত্রিপুর নামে এক অসুরের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। ত্রিপুর আসলে তিন রকমের – তারকাক্ষ, কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালী। চতুর্থবার আরাধনা করেন দেবরাজ ইন্দ্র। লক্ষ্মীকে ফিরে পাওয়ার জন্য।
মহাভারতে দুর্গাপূজার কথা বিস্তৃতভাবে রয়েছে। কপট পাশা খেলায় শকুনির কাছে দ্বিতীয়বার পরাজিত হয়ে পাণ্ডবদের বারো বছর বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস হয়। অজ্ঞাতবাসের সময়টি ছিল বেশ কঠিন। কারণ, এই সময় পাণ্ডবরা দুর্যোধনাদি কৌরবদের কাছে ধরা পড়ে গেলে তাঁদের আবারও লুকিয়ে লুকিয়ে কাটাতে হবে। এমন করে তো অনন্তকাল চলতে পারে না। এই চক্র থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যুধিষ্ঠির দেবী দুর্গার শরণ নিলেন। অজ্ঞাতবাস বড় কঠিন সময়। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি আছে নানারকমের দুঃখ। সবচেয়ে বড় যেটা, তা হল – এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম, এই আশঙ্কা। দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবরা যখন মৎস্যনগরে ঢুকছেন, তখন মনে মনে যুধিষ্ঠির ত্রিভুবনেশ্বরী দুর্গার স্তুতি করেছিলেন। সেই স্তুতি থেকে জানা যায়, দুর্গার উদ্ভব। দুর্গার জননী মা যশোদা। তিনি যশোদাগর্ভসম্ভূতা। তাঁর পিতা নন্দ।
অত্যাচারী রাজা একদিন দৈববাণী শুনতে পান যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান তাঁকে বধ করবেন। তখন তিনি দেবকী ও তাঁর স্বামী বসুদেবকে মথুরার কারাগারে বন্দি করে রাখেন। বন্দি অবস্থায় তাঁদের ছয়টি সন্তান হয়, এবং প্রত্যেকটি সন্তানকে কংস হত্যা করেন। সপ্তম সন্তান বলরাম দেবকীর গর্ভ থেকে প্রতিস্থাপিত হলেন রোহিণী দেবীর গর্ভে। রোহিণী বসুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী, তিনি থাকেন গোকুলে। ভাদ্রমাসের পূর্ণিমায় বলরামের আবির্ভাব। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে গভীর রাতে কৃষ্ণের আবির্ভাব। সেই শিশুকে পিতা বসুদেব গোপনে নিয়ে যান গোকুলে, নন্দের ঘরে। ওই রাতে যশোদার গর্ভে জন্মান কন্যাসন্তান যোগমায়া। তিনি আসলে দেবী মহাশক্তি।
পুত্রসন্তানকে মা যশোদার কাছে রেখে কন্যাটিকে নিয়ে মথুরায় ফেরেন বসুদেব। যোগমায়াকে দেবকীর ক্রোড়ে দেখতে পান কংস। ভাবেন, এই সন্তান দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত। তখন কংস তাকে শিলাতলে আছাড় মারেন। সদ্যোজাতা আকাশে মিলিয়ে যায়। এই যোগমায়াই দেবী দুর্গা – দিব্যমাল্যবিভূষিতা, দিব্যাম্বরধরা ও খড়্গখেটকধারিণী। তাঁর বর্ণ বালার্কসদৃশ, তাঁর আনন পূর্ণচন্দ্রনিভ এবং তিনি চতুর্ভূজা ও চতুর্ব্বক্ত্রা। আবার তিনি কৃষ্ণবর্ণা ও অষ্টভূজারূপেও পূজিতা হন। তাঁর আট হাতে রয়েছে – বর, অভয়, পানপাত্র, পঙ্কজ, ঘন্টা, পাশ, ধনু ও মহাচক্র। তাঁর কুণ্ডল দিব্য, মাথায় উৎকৃষ্ট কেশবন্ধ ও দিব্য মুকুট। বেণী কটিসূত্র পর্যন্ত লম্বিত। দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিনী এবং বিন্ধ্যবাসিনী।
অজ্ঞাতবাসে যুধিষ্ঠির সেই দেবীকে স্মরণ করলেন এবং তাঁর শরণাপন্ন হলেন। যুধিষ্ঠিরের স্তবে তুষ্ট দেবী দুর্গা তাঁকে নির্বিঘ্নে অজ্ঞাতবাসের বর দান করে অন্তর্হিতা হলেন।
মহাভারতের বনপর্বে আছে, সকল প্রকার দুর্গতি থেকে তিনি উদ্ধার করেন বলে তাঁর নাম দুর্গা। তিনি আসলে ভগবতী। বিরাটপর্বে তিনি নন্দগোপকূলজাতা ও যশোদাগর্ভসম্ভূতা। কিন্তু শল্যপর্বে দেবী দুর্গা শৈলপুত্রী, হিমালয়ের কন্যা। মহাভারতের অন্যত্র তিনি মহাদেবের পত্নী। অনুশাসনপর্বের উমামহেশ্বর-সংবাদে সে কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে।
দেবী দুর্গার এই যে আরাধনা, তা শুধু সঙ্কটকালের জন্য। অজ্ঞাতবাসের কঠিন সময়ে যুধিষ্ঠির যেমন দুর্গার শরণ নিয়ে মুক্তি পেলেন, তেমনি আর এক কঠিন সময়ে অর্জুনকে আশ্রয় নিতে হল দেবীর।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “হে পার্থ, তুমি যেই ধর্ম যুদ্ধে উপনীত হইয়াছ সেই ধর্মে যুদ্ধে জয়ী হইতে হইলে পরমেশ্বরী মহামায়ার কৃপা ছাড়া সম্ভব নহে। তুমি দুর্গার স্তুতি করো”।
রথ থেকে নেমে পড়লেন অর্জুন। কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবীর স্তুতিগান করলেন। সেই স্তুতিতে দেবী দুর্গা সম্পর্কে জানা যায় – তিনি যোগীদের পরম সিদ্ধিদাত্রী, ব্রহ্মস্বরূপিণী, সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণ, জরামৃত্যুবিহীনা, ভদ্রকালী, বিজয়া, কল্যাণপ্রসূ, মুক্তিস্বরূপা, সাবিত্রী, কালরূপিণী, মোহিনী, কান্তিমতী, পরম সম্পৎ, শ্রী, হ্রী ও জননী। তিনি মহাশক্তি।
অর্জুনের আকুল স্তুতি শুনে মা দুর্গা আবির্ভূত হন। তখন মা দুর্গা কে তারা প্রণাম করে উনার আশীর্বাদ কামনা করেন। তখন মা দুর্গা তাদের বলেন নারায়ণ (কৃষ্ণ) তো তোমার সাথেই আছে এই যুদ্ধে তুমি এমনিতেই জয়ী হবে। তারপর মা দুর্গা অর্জুন কে শত্রুজয়ের বর প্রদান করে আবার বিলীন হলেন।
দেবী দুর্গার স্বামী মহাদেব, শিব। বনপর্বে আছে, শিবের বাসস্থান কৈলাস পর্বত। তাঁর সহস্রনাম। শতরুদ্রীয় অধ্যায়ে ব্যাসদেব অর্জুনকে বলছেন – তিনি মহোদর, মহাকায়, ত্রিশূলপাণি, পিনাকী, সহস্রাক্ষ প্রভৃতি। তাঁর অনেক পার্ষদ আছেন। তাঁরা জটিল মুণ্ড, বিকৃতানন, বিকৃতপাদ ও বিকৃতবেশ।
দেবী দুর্গার পুত্র দেবসেনাপতি কার্তিক বা স্কন্দ তারকাসুরকে বধ করেছিলেন। অপর পুত্র গণেশ হলেন মহাভারতের লেখক।
মহাভারত পেরিয়ে বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণের হাত ধরে দেবীর অকাল বোধন হয় শরৎকালে। ঘুম ভাঙানো হয় সবার। দেবী দুর্গা আসেন ভক্তদের উদ্ধার করতে। ভক্ত কখনও যুধিষ্ঠির, কখনও অর্জুন, কখনও রামচন্দ্র, আবার কখনও স্বয়ং ভগবান।
‘দুর্গা’ কথাটি ‘দুর্গ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। যেখানে সহজে শত্রু প্রবেশ করতে পারে না, তাই দুর্গ। দুর্গ আবার রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গের অন্যতম। দুর্গ মানে হল অশক্যগমন বা অসাধ্যগমন। এক অপরাজেয় দৈত্যের নাম ছিল দুর্গ, যাকে নাশ করেছিলেন দেবী।
পুরাণ মতে দশমীতে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন।
একদা অসুররাজ মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য অধিকার করে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে দেন। অসুরদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন মুনি-ঋষিগণও। অসুরদের অত্যাচারে যখন স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল প্রকম্পিত তখন বিতাড়িত দেবতারা তখন সর্ব ক্ষমতার অধীশ্বর ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে উপস্থিত হন।
প্রজাপতি ব্রহ্মা জানালেন, কঠোর তপস্যাবলে মহিষাসুর তাঁরই কাছ থেকে বর লাভ করেছে যে ত্রিভূবনের কোনও পুরুষই তাকে পরাস্ত করতে পারবে না।
মহিষাসুরের কাহিনি শুনে শান্ত যোগীবর মহাদেবের সুগৌর মুখমন্ডল ক্রোধে রক্তজবার মত রাঙা বরণ ধারণ করলো আর শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী নারায়ণের আনন ভ্রূকুটি কুটিল হয়ে উঠলো।
তখন মহাশক্তির আহ্বানে গগনে গগনে নিনাদিত হলো মহাশঙ্খ। বিশ্বযোনি, বিষ্ণু, রুদ্রের বদন থেকে তেজরাশি বিচ্ছুরিত হলো। ব্রহ্মা ও দেবগণের আনন হতে তেজ নির্গত হলো। এই পর্বতপ্রমাণ জ্যোতিপুঞ্জ, প্রজ্জ্বলিত হুতাশনের ন্যায় দেদীপ্যমান কিরণে দিঙ্মণ্ডল পূর্ণ করে দিলে, ওই তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে, পরমা রূপবতী, দিব্যস্ত্রীমূর্তি উৎপন্ন হল, ইনিই জগন্মাত্রিকা, মহামায়া।
এক এক দেবের প্রভাবে দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল। মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙ্গুল, বসুদের তেজে হাতের আঙ্গুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূ, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতাদের তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হলো।
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে হিমালয়ের শীর্ষে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে আর্বিভূতা হলেন দেবী। ত্রিভুবনের দুর্গতি বিনাশ করার জন্যই তাঁর আবির্ভাব হয়েছে বলে দেবীর নামকরণ হল দুর্গা। ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে এই সৃষ্টিকার্য হয়েছিল বলে দেবী দুর্গার আর এক নাম রাখা হল কাত্যায়নী।
অমাবস্যা-পরবর্তী শুক্লপক্ষের তিথিতে ঋষি কাত্যায়ন দেবীর আরাধনা করলেন। দেবীর পুজো এবং স্তুতি চলাকালীন সকল দেবতারা তাঁদের সমস্ত শক্তি ও অস্ত্র দেবীকে প্রদান করলেন।
অস্ত্রই দেবতাগণের শক্তি। অসুরের অত্যাচারে উৎপীড়িত দেবগণ বুঝিলেন তাঁহাদের সকল শক্তিই সেই মহতীপরাশক্তির। স্ব স্ব শক্তিস্বরূপ আয়ুধ তাই দেবগণ সেই এক পরমাত্মা অর্থাৎ মাকে সমর্পণ করলেন।সকল ব্যাষ্টি শক্তি সমষ্টিতে রূপান্তরিত হল। পরমাত্মা মহামায়াই সকলের কারণ সমষ্টিরূপা।
জ্ঞানময় শিব তাঁর ত্রিপুটি জ্ঞানস্বরূপ(জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়, এই ত্রিপূটি জ্ঞান মহতীশক্তিরই বিশেষ প্রকাশ) ত্রিশূল মহাদেবীকে সমর্পণ করলেন।
প্রাণপুরুষ কৃষ্ণ জগৎসংসাররূপ সুদর্শনচক্র জগদ্ধাত্রী দেবীকে দান করলেন। কারণ অসুরের অত্যাচারে প্রাণ(বিষ্ণু) বুঝিলেন মহতীশক্তিতেই সমগ্ৰ সংসার ধৃত। তিনি এইরূপ বুঝিয়াই তাঁর চক্র জগদ্ধাত্রীকে সমর্পন করলেন।
এইরূপ বরুণ দেবীকে অব্যক্তনাদের প্রকাশস্বরূ শঙ্খ ও অনুরাগ বা বন্ধন রূপ পাশ প্রদান করলেন। আমি বদ্ধ এই উপলব্ধিই তো সিদ্ধি, নিজে বদ্ধ এই ভাব না থাকিলে মুক্তি হইবে কিকরে। বরুণ এই বুঝিয়া দেবীকে পাশ অর্পণ করিলেন।
অগ্নি হুতাশনের বা দাহের স্থুলরূপ শক্তি অস্ত্রপ্রদান করলেন।
বায়ু বা মারুত ধনুঃ ও শরপূর্ণ তূণীদ্বয় দিলেন। ধনু ও শর প্রবাহ শক্তির পরিচালক। বায়ুর প্রবহণই তাঁর শক্তি সেই শক্তি দেবীকে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন।
দেবাধিপতি ইন্দ্র বিশ্বময় তড়িৎশক্তি বজ্র ও তাঁর ধ্বনিস্বরূপ ঘন্টা দেবীকে দান করিলছন।
মৃত্যপতি যম কালরূপ দন্ডও যে মহতীশক্তিরই দন্ড এই বুঝিয়া তাহা মহাদেবীকে অর্পণ করলেন।
প্রজাপতি বর্ণরূপ অক্ষমালা দিলেন। যে বর্ণ হতে শব্দ বা প্রজাসমূহ সৃষ্ট তাই সেই বর্ণসমষ্টি মালা বা অক্ষমালা প্রজাপতি আদিশক্তিকে প্রদান করিলেন।
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা যেস্থানে সৃষ্টিবীজ অব্যক্ত থাকে, সেই অব্যক্তবীজই কমন্ডলু। উহা মাতৃহস্তে সমর্পণ করে ব্রহ্মা নিশ্চিন্ত হলেন।
মহাশক্তির প্রকাশেই সূর্য প্রকাশিত, তাই সূর্য তাঁর সকল রশ্মিসকল মাঁয়ের প্রত্যেক রোমকূপে দান করিলছন।
মহাকাল যিনি এই জগতের আধার তিনি পরমেশ্বরীকে মায়ার বিচ্ছেদকারক জ্ঞান খড়্গ ও আচ্ছাদনকারক ঢাল অর্পণ করলেন।
অব্যক্ত অখন্ড প্রকৃতিকে অর্থাৎ মায়াকে যিনি বিশিষ্ট নাম ও রূপে পরিমিত করেন তিনিই বিশ্বকর্মা। বেদে ইনিই ত্বষ্টা। তিনি যে সেই মহতীশক্তির কপাতেই এইসকল করিয়া থাকেন তাহা বেশ উপলব্ধি করিয়া তাঁর পরশ ও আরও অস্ত্র ও অভেদ্য কবচ প্রদান করলেন।
ধনাধিপতি কুবের আনন্দরূপ সুরাপূর্ণ পান পাত্র দিলেন। বিষয়রূপ সুরায় মুগ্ধ হয়ে সে বুঝিতে পারেনি এই সুরা কি? তাই অসুরের অত্যাচারে স্বর্গভ্রষ্ট। এই সুরাই যে আসলে আনন্দময়ী মাঁ ইহা বুঝিয়াই সে ভগবতীকে সুরাপূর্ণ পাত্র নিবেদন করিলেন।
সত্ত্বগুণরূপী ক্ষীরসমুদ্র দেবীকে বিবিধ অলঙ্কারে সুসজ্জিত করিলেন যথা :-
অমলহার- বিশুদ্ধ প্রকাশ শক্তি, বস্ত্রযুগল- মায়া ও অবিদ্যা, ইহারাই পরমাত্মা মহামায়ার হেম বপুর আচ্ছাদন।
দিব্য চূড়ামনি- স্বর্গীয় শিরোভূষণ। ইহাই দিব্যজ্ঞান যার ফলে সকল তত্ত্ব অসঙ্কির্ণভাবে উপলব্ধি করা য়ায়।
কুন্ডলদ্বয়- কর্ণভূষণ। অন্তরে যে অনাহত ধ্বনি হয় তাহাই স্পষ্টরূপে শ্রবণের জন্য ইহা দিব্য শ্রবণ শক্তি।
কটক- হাতের বালা। একস্থানে থাকিয়াও বহুদূরস্থ বস্তু গ্ৰহণের যে শক্তি, ইহাই কটক। ইহা গ্ৰহণশক্তি।
অর্দ্ধচন্দ্র- ললাট ভূষণ। আজ্ঞাচক্র হইতে যে বিজ্ঞানজ্যোতির প্রকাশ হয় ইহাই ললাটস্থিত অর্দ্ধচন্দ্র।
কেয়ূর- ইহাও বাহুভূষণ। ইহা ধারণশক্তির দ্যোতক।
নূপুর- পদভূষণ বা দিব্য গতিশক্তির দ্যোতক।
গ্ৰৈবেয়ক- কন্ঠভূষণ। দিব্য স্বরশক্তির দ্যোতক।
অঙ্গুরীয়ক রত্ন- অঙ্ক্ষটি। দিব্যস্পর্শশক্তির দ্যোতক।
তমোগুণরূপী সমুদ্র দেবীকে বক্ষ ও মস্তকে ধারণ করিবার জন্য পঙ্কজমালা ও হাতে একটি পদ্মফুল দিলেন। সংস্কারশ্রেণীরূপে পাপই পঙ্কজমালা। ইহাও সমুদ্র দেবীকে দিয়ে কৃতার্থ হলেন। আগামী সংস্কার শ্রেণী মায়ের শিরের পঙ্কজমাল্য। সঞ্চিত সংস্কারশ্রেণী মাঁয়ের বক্ষস্থলের পঙ্কজমাল্য ও প্রারব্ধ সংস্কার যা একটি জন্মেই উলব্ধি হয়ে নির্মূল হইয়া যায়, পরেই জীবের মুক্তি। তাই প্রারব্ধ সংস্কাররাশি দেবী হস্তস্থিত একটি পঙ্কজ হইয়া থাকেন। এক মহতীই মধুকৈটভ, মহিষাসুর ও শুম্ভনিশুম্ভাদি সকল দৈত্যকে মাঁই পঙ্কজরূপে ধারণ করেন।
দেহাত্মবোধের প্রতি হিংসাপরায়ণ হওয়া সিংহধর্মী হওয়া। জড়াদর্শ হিমালয় সেই ঘনীভূত দেহাত্মবোধ এবং এঁর প্রতি হিংসা এই ভাবই পরব্রহ্ম মহাশক্তির বাহক হওয়ায়ে তার পূর্ণতাপ্রাপ্ত। তাই হিমালয় দেবীকে বাহনরূপী সকলপশুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জীবরূপী বিক্রমশালী সিংহ প্রদান করলেন এবং তার সাথে বহুবিধ রত্ন অর্থাৎ কর্মফল মাতৃচরণেই নিবেদন করলেন।
কর্মাশয় থেকে যে যাবতীয় ক্ষুদ্র মহৎ যাবতীয় যে শক্তির বিকাশ হয় তাহাই শেষ কে সর্বশেষ বলা হয়েছে। অবশেষামৃত সংস্কার বীজ। ইনিই শেষ নাগ যাঁহার উপর প্রাণপুরুষ বিষ্ণু শায়িত থাকেন। তিনি ভগবতী পরমেশ্বরীকে, মোক্ষফল সুশোভিত কুলকুন্ডলিনীই (মণি বিভূষিত নাগহার) অর্পণ করিলেন।
এইরূপ সকল ব্যাষ্টিশক্তি সেই সমষ্টিতে অর্পিত হলেন। দেবগণ বুঝিলেন তাঁহাদের সকল কিছুই মহামায়ার শক্তি বা প্রকাশ ভিন্ন কিছু নহে, সেই পরাশক্তিই একমাত্র কর্তা, হন্তা, বিধাতা ও ভোক্তা। তাই জীব এইবার সর্বতোভাবে মাতৃচরণে সমর্পিত হইলেন। মহিষাসুরের নিধন এইবার অনিবার্য।
এরপর দেবতারা সকলে মিলিত হয়ে স্মরণ নিলেন — “ॐ দুর্গে দুর্গে রক্ষিণি স্বাহাঃ”। দেবীকে দেবতারা মহিষাসুর বধের জন্য প্রার্থনা জানালেন। মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে দেবী হলেন দশভুজা, যিনি সর্ব শক্তির অধিকারী। দেবীর রণ হুঙ্কারে ও তাঁর বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন কম্পিত হতে লাগল।
মহিষাসুর সেই প্রকম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তাঁর সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী দুর্গা প্রবল পরাক্রমে এবং কৌশলের সঙ্গে ভয়ানক হিংস্র অসুরবাহিনীকে পরাজিত করলেন।
দেবী যুদ্ধে আহ্বান করলেন মহিষাসুরকে। দেবী দুর্গা অপরূপা সুন্দরী রূপে প্রতাপশালী মহিষাসুরের সামনে উপস্হিত হন। এই সময় দেবীর গাত্রবর্ন ছিল সোনালী এবং দেবীর পরিধেয় বস্ত্র ছিল হলুদ রঙের। তার দশ হাত সজ্জিত ছিল দশ ধরনের মারনাস্ত্রে।
শুরু হল মহিষাসুর এবং দেবী দুর্গার সমর। সে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ! দেবী ও মহিষাসুরের দৃপ্ত, উন্মত্ত পদ চালনায় স্বর্গ-মর্ত-পাতাল কাঁপতে থাকল। মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে, নানা ছলে, কৌশলে দেবীকে বিব্রত ও বিমোহিত করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু দেবী সেই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন।
দেবী মহিষাসুরের সঙ্গে তখন যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই অসুর পিছন থেকে দেবীকে আক্রমন করে। তখন দেবী তার ত্রিনয়ন উন্মীলিত করে চামুণ্ডা রূপে চণ্ড ও মুণ্ডকে বধ করলেন অষ্টমী-নবমীর সন্ধিতে।
এরপর দশমীতে যুদ্ধক্ষেত্রে মহিষাসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করতেই দেবী বললেন —
“গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম।
ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।।”
- রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন।
এই বলে দেবী লম্ফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর চড়ে তাঁর কণ্ঠে পা দিয়ে শূলদ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ করে মহিষাসুরকে বধ করলেন। অসুরসেনা হাহাকার করতে করতে পলায়ন করল।
স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে সকল দেবতারা একত্রিত হয়ে দেবী দুর্গার জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। চতুর্দিকে পুষ্পবৃষ্টি হল। দেবতারা আবার স্বর্গের অধিকার ফিরে পেলেন।
প্রিয় বন্ধুরা আজকের অনুষ্ঠান এই পর্যন্তই। আশা করছি আজকের ভিডিওটি আপনার ভালো লেগেছে। খুব তারা তারি আপনাদের কাছে অন্য কোনো অজানা তথ্যের রহস্যময় ভিডিও নিয়ে আবার ফিরে আসবো । সকলে ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন ,দূর্গা পূজায় খুব আনন্দ করুন আর দেখতে থাকুন আমাদের চ্যানেল সমাধান।