বর্তমান কালে পৃথিবীতে সবচেয়ে জাঁকজমকভাবে যে সমস্ত ধর্মীয় উৎসব পালিত হয় তার একটা নিঃসন্দেহে ক্রিসমাস। বড়দিন।“মেরি ক্রিসমাস” অর্থাৎ “শুভ হোক খ্রীষ্টের জন্মোতসব”; যদিও এ অর্থ মাথায় রাখে না মানুষ বলার সময়। সংক্ষেপে X-Masও লিখা হয় ক্রিসমাস বুঝাতে।
ক্রিসমাস উদযাপন মূলত যীশুর জন্মদিন পালন। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে এ দিন যীশু জন্ম নেন এ পৃথিবীতে মা মেরীর গর্ভ থেকে। য়িহূদিয়ার রাজা হেরোদের সময়ে সখরিয় নামে একজন যাজক ছিলেন ৷ ইনি ছিলেন অবিয়ের দলের যাজকদের একজন ৷ সখরিয়র স্ত্রী ইলীশাবেত্ ছিলেন হারোণের বংশধর ৷ তাঁরা উভয়েই ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ধার্মিক ছিলেন৷ প্রভুর সমস্ত আদেশ ও বিধি-ব্যবস্থা তাঁরা নিখুঁতভাবে পালন করতেন৷ ইলীশাবেত্ বন্ধ্যা হওযার দরুন তাঁদের কোন সন্তান হয় নি৷ তাঁদের উভয়েরই অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল৷ একবার তাঁর দলের যাজকদের ওপর দাযিত্বভার পড়েছিল, তখন সখরিয় যাজক হিসেবে মন্দিরে ঈশ্বরের সেবা করছিলেন৷ এমন সময় প্রভুর এক স্বর্গদূত সখরিয়র সামনে এসে উপস্থিত হয়ে ধূপবেদীর ডানদিকে দাঁড়ালেন৷ সখরিয় সেই স্বর্গদূতকে দেখে চমকে উঠলেন এবং খুব ভয় পেলেন৷ কিন্তু স্বর্গদূত তাঁকে বললেন, ‘সখরিয় ভয় পেও না, কারণ তুমি যে প্রার্থনা করেছ, ঈশ্বর তা শুনেছেন৷ তোমার স্ত্রী ইলীশাবেতের একটি পুত্র সন্তান হবে, তুমি তার নাম রাখবে য়োহন৷ প্রভুর দৃষ্টিতে য়োহন হবে এক মহান ব্যক্তি৷ সে অবশ্যই দ্রাক্ষারস বা নেশার পানীয় গ্রহণ করবে না৷ জন্মের সময় থেকেই য়োহন পবিত্র আত্মায় পূর্ণ হবে৷ য়োহন এলীয়েরআত্মায় ও শক্তিতে প্রভুর আগে চলবে৷ সে পিতাদের মন তাদের সন্তানদের দিকে ফেরাবে, আর অধার্মিকদের মনের ভাব বদলে ধার্মিক লোকদের মনের ভাবের মতো করবে৷ প্রভুর জন্য সে এইভাবে লোকদের প্রস্তুত করবে৷’ তখন সখরিয় সেই স্বর্গদূতকে বললেন, ‘আমি কিভাবে জানব যে সত্যিই এসব হবে, কারণ আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি, আর আমার স্ত্রীরও অনেক বয়স হয়ে গেছে৷’ এর উত্তরে স্বর্গদূত তাঁকে বললেন, ‘আমি গাব্রিয়েল, ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি; আর তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ও তোমাকে এই সুখবর দেবার জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে৷ কিন্তু জেনে রেখো! এইসব ঘটনা ঘটা পর্যন্ত তুমি বোবা হয়ে থাকবে, কথা বলতে পারবে না, কারণ তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না, কিন্তু আমার এইসব কথা নিরুপিত সময়েই পূর্ণ হবে ৷’ এর কিছুক্ষণ পরে তার স্ত্রী ইলীশাবেত্ গর্ভবতী হলেন; আর পাঁচ মাস পর্যন্ত লোক সাক্ষাতে বের হলেন না৷ ইলীশাবেত্ যখন ছমাসের গর্ভবতী, তখন ঈশ্বর গাব্রিয়েল, স্বর্গদূতকে গালীলে নাসরত্ নগরে এক কুমারীর কাছে পাঠালেন৷ এই কুমারী ছিলেন য়োষেফ নামে এক ব্যক্তির বাগদত্তা৷ য়োষেফ ছিলেন রাজা দায়ুদের বংশধর, আর যে কুমারীর কাছে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল তাঁর নাম মরিয়ম৷ স্বর্গদূত তাঁকে বললেন, ‘মরিয়ম তুমি ভয় পেও না, কারণ ঈশ্বর তোমার ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন৷ শোন! তুমি গর্ভবতী হবে আর তোমার এক পুত্র সন্তান হবে৷ তুমি তাঁর নাম রাখবে যীশু৷ তিনি হবেন মহান, তাঁকে পরমেশ্বরের পুত্র বলা হবে, আর প্রভু ঈশ্বর তাঁর পিতৃপুরুষ রাজা দায়ুদের সিংহাসন তাঁকে দেবেন৷ তখন মরিয়ম স্বর্গদূতকে বললেন, ‘এ কেমন করে সম্ভব কারণ আমি তো কুমারী!’ এর উত্তরে স্বর্গদূত বললেন, ‘পবিত্র আত্মা তোমার ওপর অধিষ্ঠান করবেন আর পরমেশ্বরের শক্তি তোমাকে আবৃত করবে; তাই যে পবিত্র শিশুটি জন্মগ্রহণ করবে তাঁকে ঈশ্বরের পুত্র বলা হবে৷ আর শোন, তোমার আত্মীয়া ইলীশাবেত্ যদিও এখন অনেক বৃদ্ধা তবু সে গর্ভে পুত্রসন্তান ধারণ করছে৷ এই স্ত্রীলোকের বিষয়ে লোকে বলত যে তার কোন সন্তান হবে না, কিন্তু সে এখন ছমাসের গর্ভবতী৷ কারণ ঈশ্বরের পক্ষে কোন কিছুই অসাধ্য নয়!’ মরিয়ম বললেন, ‘আমি প্রভুর দাসী৷ আপনি যা বলেছেন আমার জীবনে তাই হোক্!’ এরপর স্বর্গদূত মরিয়মের কাছ থেকে চলে গেলেন৷ তখন মরিয়ম উঠে তাড়াতাড়ি করে য়িহূদার পার্বত্য অঞ্চলের একটি নগরে গেলেন৷ সেখানে সখরিয়র বাড়িতে গিয়ে ইলীশাবেতকে অভিবাদন জানালেন৷ ইলীশাবেতের ঘরে মরিয়ম প্রায় তিনমাস থাকলেন৷ ইলীশাবেতের প্রসবের সময় হলে তিনি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন৷ শিশুটি যখন আট দিনের, সেইসময় তাঁরা শিশুটিকে নিয়ে সুন্নত করাতে এলেন৷ সবাই শিশুটির বাবার নাম অনুসারে শিশুর নাম সখরিয় রাখার কথা চিন্তা করছিলেন৷ কিন্তু তার মা বলে উঠলেন, ‘না! ওর নাম হবে য়োহন৷’

য়োহন মরুপ্রান্তরে লোকদের প্রচার করেছিলেন যেন লোকেরা পাপের ক্ষমা পাবার জন্য মন-ফেরায় ও বাপ্তিস্ম নেয়৷ তিনি প্রচার করতেন, ‘আমার পরে এমন একজন আসছেন, যিনি আমার থেকে শক্তিমান, আমি নীচু হয়ে তাঁর পায়ের জুতোর ফিতে খোলার য়োগ্য নই৷ সেই সময় যীশু গালীলের নাসরত্ থেকে এলেন আর য়োহন তাঁকে যর্দন নদীতে বাপ্তাইজ করলেন৷ জল থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখলেন, আকাশ দুভাগ হয়ে গেল এবং পবিত্র আত্মা কপোতের মতো তাঁর ওপর নেমে আসছেন৷ আর স্বর্গ থেকে এই রব শোনা গেল, ‘তুমিই আমার প্রিয় পুত্র৷ আমি তোমাতে খুবই সন্তুষ্ট৷’ সেই সময় আগস্ত কৈসর হুকুম জারি করলেন যে, রোম সাম্রাজ্যের সব জায়গায় লোক গণনা করা হবে৷ এটাই হল সুরিয়ার রাজ্যপাল কুরীণিয়ের সময়ে প্রথম আদমশুমারি৷ আর প্রত্যেকে নিজের নিজের শহরে নাম লেখাবার জন্য গেল৷ য়োষেফ ছিলেন রাজা দায়ুদের বংশধর, তাই তিনি গালীল প্রদেশের নাসরত্ থেকে রাজা দায়ুদের বাসভূমি বৈত্‌লেহমে গেলেন৷ য়োষেফ তাঁর বাগদত্তা স্ত্রী মরিয়মকে সঙ্গে নিয়ে নাম লেখাতে চললেন৷ এই সময় মরিয়ম ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা৷ তাঁরা যখন সেখানে ছিলেন, তখন মরিয়মের প্রসব বেদনা উঠল৷ আর মরিয়ম তাঁর প্রথম সন্তান প্রসব করলেন৷ তিনি সদ্যজাত সেই শিশুকে কাপড়ের টুকরো দিয়ে জড়িয়ে একটি জাবনা খাবার পাত্রে শুইয়ে রাখলেন, কারণ ঐ নগরের অতিথিশালায় তাঁদের জন্য জায়গা ছিল না৷ সেখানে গ্রামের বাইরে মেষপালকেরা রাতে মাঠে তাদের মেষপাল পাহারা দিচ্ছিল৷ এমন সময় প্রভুর এক স্বর্গদূত তাদের সামনে উপস্থিত হলে প্রভুর মহিমা চারদিকে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিল৷ এই দেখে মেষপালকরা খুব ভয় পেয়ে গেল৷ সেই স্বর্গদূত তাদের বললেন, ‘ভয় নেই, দেখ আমি তোমাদের কাছে এক আনন্দের সংবাদ নিয়ে এসেছি৷ এই সংবাদ সকলের জন্য মহা আনন্দের হবে৷ কারণ রাজা দাযূদের নগরে আজ তোমাদের জন্য একজন ত্রাণকর্তার জন্ম হয়েছে৷ তিনি খ্রীষ্ট৷ ‘স্বর্গে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাঁর প্রীতির পাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি৷’

:- বিশ্বব্যাপী পালিত এ জন্মদিন কি আসলেই জন্মদিন? নাকি একটি মিথ্যা সে নিয়ে ও রয়েছে বিস্তর সন্দেহ। প্রকৃতিগতভাবে একটি খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও, একাধিক অ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও মহাসমারোহে বড়দিন উৎসব পালন করে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসবের আয়োজন প্রকৃত খ্রিস্টানদেরকে ও ছাড়িয়ে যায়। উপহার প্রদানের রীতি সহ বড়দিন উৎসবের নানা অনুষঙ্গ খ্রিষ্টান ও অ-খ্রিষ্টানদের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসব উপলক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বিশেষ মরসুম চলে। বিগত কয়েকটি শতাব্দীতে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বড়দিনের অর্থনৈতিক প্রভাবটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে দেখে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশে বড়দিন একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। সাধারণত বড়দিনের পূর্বের সপ্তাহগুলিতে বন্ধুবান্ধব ও পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে খ্রিষ্টমাস কার্ড আদানপ্রদান চলে। পাশ্চাত্য সমাজ ও এশিয়ার অখ্রিষ্টান সম্প্রদায় সহ এক বিরাট সংখ্যক জনসাধারণের মধ্যে এই প্রথা জনপ্রিয়। চিরাচরিত শুভেচ্ছাবার্তার বাণীটি হল “পবিত্র খ্রিষ্টমাস ও শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন”।

:- বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার ইতিহাসটি অতি প্রাচীন। প্রাক-খ্রিষ্টীয় যুগে, রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসী শীতকালে চিরহরিৎ বৃক্ষের শাখাপ্রশাখা বাড়ির ভিতরে এনে সাজাত। খ্রিষ্টানরা এই জাতীয় প্রথাগুলিকে তাদের সৃজ্যমান রীতিনীতির মধ্যে স্থান দেয়।অস্ট্রেলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপে বাড়ির বাইরে আলোকসজ্জা, এবং কখনও কখনও আলোকিত স্লেজ, স্নোম্যান, ও অন্যান্য খ্রিষ্টমাস চরিত্রের পুতুল সাজানোর প্রথা রয়েছে। পউরসভাগুলিও এই সাজসজ্জার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। রাস্তার বাতিস্তম্ভে খ্রিষ্টমাস ব্যানার লাগানো হয় এবং টাউন স্কোয়ারে স্থাপন করা হয় খ্রিষ্টমাস বৃক্ষ.

:-অনেক দেশেই বড়দিন বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে উপহার আদানপ্রদানের মরসুম। উপহার আদানপ্রদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একাধিক খ্রিষ্টীয় ও পৌরাণিক চরিত্রের উদ্ভবের সঙ্গেও বড়দিন উৎসব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এদের মধ্যে ফাদার খ্রিষ্টমাস বা সান্টাক্লজ হলেন অন্যতম । শিশুদের বিশ্বাস করানো হয়, সান্তা ক্রিসমাস এর আগের রাতে সবাইকে গিফট দিয়ে যান “মোজায়“ ভরে। সাদা দাঁড়ির মোটাসোটা লাল পোশাকের এ লোক থাকেন উত্তর মেরুতে। তাঁর সাথে আছে অসংখ্য জাদুকরি এলফ আর উড়ন্ত বল্গা হরিণ। এলফ-রা গিফট প্রস্তুত করে। তিনি সেটা তাঁর স্লেজ গাড়ি করে উড়ে উড়ে দিয়ে আসেন।

প্রিয় বন্ধুরা আজকের অনুষ্ঠান এপর্যন্তই। আমাদের চ্যানেলের পক্ষ থেকে আপনাদের ও আপনাদের পরিবারের সকলকে জানায় পবিত্র খ্রিষ্টমাস ও শুভ নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা । সকলে ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন , খুব খুব আনন্দ করুন আর দেখতে থাকুন আমাদের চ্যানেল সমাধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *